অবশেষে কক্সবাজারে ট্রেন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে কালুরঘাট সেতুকে। আজ (৫ নভেম্বর) পূর্ণাঙ্গ একটি ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রায়াল দেওয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো মুখ খুলছে না রেলের কেউ। বলা হচ্ছে, ট্রায়াল হবে। রেলের টেকনিক্যাল টিম খুঁটিনাটি বিষয় দেখবেন। কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ইঞ্জিন চালিয়ে লোড টেস্ট করা হয়েছে কয়েক ধাপে। সবকিছু সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ১১ নভেম্বর কক্সবাজারে উপস্থিত থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ সেতুর কারণে প্রকল্পটি আটকে ছিল। কারণ নতুন সেতু নির্মাণ করতে ব্যয় হবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এটি নির্মাণও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে বুয়েট টিম এ সেতুর ওপর দিয়ে রেল চলাচল করতে পারবে বলে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার পর কাজ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটারেরও বেশি রেলপথ নির্মাণের পর ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেললাইন সবার জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।
দেশের মানুষ সব সময় চেয়েছিলেন ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হোক। চট্টগ্রামের মানুষও দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে রেলে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠছিল না। ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ নিয়ে অনেক আগে থেকে কথা চলছিল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত আসে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ না হলে ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ হয়ে উঠবে না। সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পে সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু ট্রান্স এশীয় রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত হতে ব্রডগেজ রেলপথ লাগবে। তাই প্রকল্প সংশোধন করা হয় ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল। এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাস করা হয়। সেই মতে শুরু হয় কাজ। জমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গে ব্যয় দাঁড়ায় ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। সমীক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রামে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকট গুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত আরো ২৮ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ রেলপথে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনে ট্রেন চলতে পারে।
প্রকল্প নিলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কর্ণফুলীর ওপর দিয়ে নতুন সেতু নির্মাণের বিষয়টি। এ সময় দুইভাবে বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলে। একটি হলো নতুন সেতু নির্মাণ, অন্যটি হলো পুরোনো সেতুর ওপর দিয়ে রেল চলাচল। এ সময় বিশেষজ্ঞরা বলছিল, কক্সবাজার রেল নিতে হলে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেললাইন যুক্ত রোড ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। যেহেতু ২০১০ সালে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প নেওয়া হয়, সেই হিসেবে ২০১৪ সালে কর্ণফুলী সেতুর ওপর নতুন ব্রীজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত আসে। ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করা যাবে বলে প্রকল্প তৈরি হয়। এ ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে আসে। পরে প্রকল্পটি দীর্ঘসূত্রতায় আটকে যাবে বলে মত প্রকাশ করে পুরোনো সেতু মেরামত করে রেল চলাচল করতে পারবে বলে মত দেওয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৪ হাজার কোটি টাকা লাগবে এবং এটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে ২০২৮ সাল পর্যন্ত। পরে পুরোনো সেতুর ওপর সংস্কার কাজ শুরু হয়। ৫০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে সেতুটির ওপরের অংশ মেরামত করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়। ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন চালু হওয়ার পর গতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার ধরা হলেও কালুরঘাট সেতুর ওপর গতি কমানো হবে।
জানা গেছে, কালুরঘাট সেতু ১৯৩১ সালে নির্মাণ করে ব্রিটিশরা। এটি একটি মজবুত পিলার সেতু। ১৯৬২ সালে এ সেতুর ওপর মিটার গেজ সিঙ্গেল রেললাইন স্থাপন করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে রেলপথটি কার্যকারিতা হারায়।
রবিবারের টেস্ট রানের ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষ গোপনীয়তা বজায় রাখছে। এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বললেও জানা গেছে, রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, টেকনিক্যাল টিম সরাসরি ট্রেন নিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবেন। এর মধ্যে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার রেল স্টেশনও প্রস্তুত করা হয়েছে। ট্রায়াল রান সফলভাবে শেষ হওয়ার পর ১১ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, শুরুতে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। পরবর্তী সময়ে নকশায় পরিবর্তন এনে বাস্তবায়নের নতুন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরুর পর এই মেগা প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সাল পর্যন্ত গড়ায়। প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে তৈরি হয় ঝিনুকের আদলে দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন। এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ব্যয় দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
পাঠকের মতামত